আজ শুক্রবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৭:৩০ অপরাহ্ন
নিজস্ব প্রতিনিধি মৌলভীবাজার
২২ নভেম্বর ছিল দানবীর রণদা প্রসাদ সাহার জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে অনুষ্ঠান। একজন রণদা প্রসাদ সাহা বা সংক্ষেপে আর পি সাহার জীবন আগামী প্রজন্মের জন্য অবশ্য পাঠ্য হওয়া উচিত। কারণ এমন জীবনের কথা আমার জীবনে আর একটিও শুনিনি বা কোথাও পঠ করিনি। ‘দানবীর রণদা প্রসাদ সাহার জন্ম ইংরেজী ১৮৯৬ সালের ১৫ নবেম্বর সাভারের অদূরে শিমুলিয়ার কাছৈড় গ্রামের মাতুলালয়ে। পিতার নাম দেবেন্দ্রনাথ পোদ্দার, মাতা কুমুদিনী দেবী। তিন ভাই এক বোনের মধ্যে রণদা প্রসাদ দ্বিতীয়। রণদা প্রসাদ সাহার পৈতৃক নিবাস বর্তমান টাঙ্গাইল জেলার মির্জাপুর উপজেলা সদরে। রণদা প্রসাদ সাহা ছোট বেলা থেকেই অত্যন্ত চালাক-চতুর, হাসিখুশি ও দুরন্ত প্রকৃতির ছিলেন। চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত মির্জাপুর বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেন। তাঁর বয়স যখন সাত বছর, তখন দারিদ্র্য আর অবহেলায় চোখের সামনে মায়ের অসহায় মৃত্যু প্রত্যক্ষ করেন। এই মৃত্যুই তাঁর জীবনে চরম প্রভাব ফেলে। হয়ত তখনই মনের মধ্যে দানা বাঁধে মানুষের জন্য, মানবতার জন্য একটা কিছু করতে হবে। সন্তানদের লালন পালনের জন্য পিতা দেবেন্দ্রনাথ আত্মীয়-পরিজনের পরামর্শে দ্বিতীয় বিবাহ করেন। সৎ মায়ের আশ্রয়ে বহু দুঃখ-কষ্ট ও অভাব অনটনের মধ্য দিয়ে রণদার শৈশবকাল অতিবাহিত হয়। শৈশব থেকে মানব কল্যাণের যে স্বপ্ন নিজের মনে লালন করেছিলেন তার বাস্তবায়ন শুরু হয় ১৯৩৮ সালে মাতামহীর নামে শোভা সুন্দরী ডিস্পেন্সারি ও মায়ের নামে কুমুদিনী হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষে আড়াই শতাধিক লঙ্গরখানা পরিচালনা করেন তিনি। রণদা প্রসাদের আহ্বানে ১৯৪৪ সালে অবিভক্ত বাংলার গভর্নর লর্ড আর জি কেসি কলকাতা থেকে নদীপথে দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে এক অজ পাড়াগাঁয়ে এসে কুমুদিনী হাসপাতাল আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সঙ্কটময় সময়ে রণদা রেডক্রসকে আড়াই লাখ রূপি দান করেন। ওই টাকায় সে সময়ে ঢাকা শহরের একটি বিশাল অংশ কিনে ফেলা যেতে পারত। অবহেলিত নারী সমাজকে পাদপ্রদীপের আলোয় আনতে ও স্বাবলম্বনে ১৯৪০ সালে তাঁর প্র-পিতামহী ভারতেশ্বরী দেবীর নামানুসারে প্রতিষ্ঠা করেন নারী শিক্ষার অনন্য প্রতিষ্ঠান ভারতেশ্বরী হোমস্। শৃঙ্খলা ও নিয়ামানুবর্তিতার জন্য ভারতেশ্বরী হোমসের নাম দেশজুড়ে সুবিদিত। পূর্ববাংলার প্রথম মহিলা ডিগ্রী কলেজ কুমুদিনী মহিলা কলেজ, মানিকগঞ্জে পিতার নামে দেবেন্দ্র কলেজ, মির্জাপুর কলেজ, মির্জাপুর এস কে হাইস্কুল ভবন নির্মাণ, মাগুরার হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ প্রতিষ্ঠায় মোটা অঙ্কের আর্থিক অনুদান, ঢকার কম্বাইন্ড মিলিটারি হসপিটাল (সিএমএইচ)-এর প্রসূতি বিভাগ প্রতিষ্ঠায় আর্থিক সহযোগিতা প্রদান করেন। এছাড়া আরও নানা জনহিতকর প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন।
ঢাকা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের প্রথম ভবনটিও ১৯৫৪ সালে তারই দানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
রণদা প্রসাদ সাহা ছিলেন সংস্কৃতিপ্রাণ মানুষ। অন্যের মধ্যে শিল্প ও সংস্কৃতির গুণ দেখলে তিনি যেমন তা উস্কে দিতেন, তেমনি নিজেও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন। শুরু থেকেই ভারতেশ্বরী হোমসে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন তিনি। ১৯৪৮ সালে মির্জাপুরে বিপুল উৎসাহ নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন সৌখিন নাট্যসংঘ ও মঞ্চ। এমন আধুনিক মঞ্চ তখন পূর্ববাংলার রাজধানী ঢাকায়ও ছিল না। তিনি নিজেও অভিনয় করতেন।
১৯৭১সালে ৭ মে পাকিস্তানি হানাদারদের দোসর রাজাকার-আলবদররা নারায়ণগঞ্জ থেকে রণদা প্রসাদ ও তার পুত্র ভবানী প্রসাদ সাহা রবিকে ধরে নিয়ে যায়। তারপর তাদের আর কোনো খোঁজ মেলেনি। ধারণা করা হয় সেই দিনই তাদের হত্যা করা হয়। পাক হানাদার বাহিনীর দোসররা স্বামী ও সন্তানকে ধরে নেওয়ার পর থেকেই শোকে শয্যাশায়ী হন রণদা প্রসাদের স্ত্রী কিরণবালা দেবী। শেষ জীবনে তিনি নির্বাক হয়ে যান। দীর্ঘদিন শয্যাশায়ী থাকার পর ১৯৮৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি পরলোকগমন করেন তিনি।
রণদা প্রসাদ সাহার নাতনী রাজিব প্রসাদ সাহা তার দাদুর আদর্শকে সমুন্নত রাখতে নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছেন। তার যোগ্য নেতৃত্বে কুমুদিনী কল্যাণ সংস্থার বেশ কয়েকটি নতুন প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এরমধ্যে কুমুদিনী মহিলা মেডিক্যাল কলেজ, কুমুদিনী নার্সিং কলেজ, নারায়ণগঞ্জে রণদা প্রসাদ সাহা বিশ্ববিদ্যালয় অন্যতম।