আজ বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১:১৩ অপরাহ্ন
নিজস্ব প্রতিবেদক :–
কেউ তার মৃত স্বামীর রেখে যাওয়া শেষ সম্বল জমা রেখেছিলেন। কেউ রেখেছিলেন সন্তানের কষ্টে উপার্জিত টাকা। আবার কারো গরু-ছাগলন হাঁস-মুরগি বিক্রির টাকা।
সমবায় সমিতির নিবন্ধন খুলে উচ্চ লাভের প্রলোভন দেখিয়ে গ্রামের সহজ-সরল গ্রাহকদের থেকে অন্তত দশ কোটি নিয়ে উধাও হয়ছে একই মালিকানাধীন দুইটি সমবায় সমিতির সভাপতি আব্দুর রব।
এখন টাকা ফেরত পাওয়ার আশায় অফিসের সামনে রাত-দিন পার করছেন আমানতকারীরা। টাকা ফেরত পাওয়া নিয়ে চরম উৎকণ্ঠায় রয়েছেন তারা।
ভোলার দৌলতখান উপজেলার একই মালিকানাধীন সমবায় অধিদপ্তরের অনুমোদিত আইডিয়াল মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড ও নিউ আইডিয়াল মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি নামের দুইটি আর্থিক সংস্থা দীর্ঘ একযুগেরও বেশি সময় ধরে গ্রাহকের জমানো অর্থ আত্মসাৎ করে আসছে। সংস্থা দুটিতে দীর্ঘ একযুগেরও বেশি সময় ধরে এমন অবৈধ কার্যক্রম চললেও বিষয়টি জানে না জেলার তদারকি সংস্থা।
জানা গেছে, প্রায় একযুগ আগে দৌলতখান পৌরসভার ৭নং ওয়ার্ডে আইডিয়াল মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড যাত্রা শুরু করে। পরবর্তী সময়ে একই উপজেলার নুরমিয়ার হাটে নিউ আইডিয়াল মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি নামে আরেকটি শাখার কার্যক্রম পরিচালনা করছিল সংস্থা দুইটির সভাপতি একই পৌরসভার বাসিন্দা আব্দুর রব। অভিযোগ উঠেছে গ্রাহকের টাকায় আব্দুর রব নামে-বেনামে প্লট কিনেছেন, হাউজিং ব্যবসাসহ করেছেন স্থানীয় পৌরসভায় কাউন্সিলর নির্বাচন।
এছাড়া সমবায় সমিতির আইনের তোয়াক্কা না করে আব্দুর রব নিজে ওই সমবায় সমিতি দুটির সভাপতি পদ ও তার নিজের পরিবারের সদস্যদের সমিতির বিভিন্ন পদে সদস্য বানিয়ে দীর্ঘদিন ধরে এমন অবৈধ কার্যক্রম পরিচালনা করে এসেছেন।
আরও জানা গেছে, সমবায় দুটি চালুর পর গ্রাহকের আমানত ও ডিপিএসের জমানো টাকার ওপরে নির্দিষ্টহারে কিছু লাভ দিলেও গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতন হলে সংস্থার কার্যক্রম গুটিয়ে নেন।
একপর্যায়ে গত মাসের নভেম্বরে সংস্থার অফিসে তালা মেরে আত্মগোপনে চলে যান সংস্থার সভাপতি আব্দুর রব। রব পালিয়ে যাওয়ার পর গ্রাহকদের চাপের মুখে সংস্থার অফিস দুটিতে তালা মেরে আত্মগোপনে চলে যান সংস্থার অন্যান্য কর্মীও মাঠকর্মীরাও।
সরেজমিনে সমবায় সমিতির শাখা দুটির কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায় শাখা তালাবদ্ধ। অন্যদিকে টাকা ফেরত পাওয়ার আশায় শাখা দুটির কার্যালয় ও অফিসের সামনে চুক্তিপত্র হাতে নিয়ে প্রতিদিনই ভিড় করছেন সর্বস্ব হারানো গ্রাহকরা।
কার্যালয় তালাবদ্ধ দেখে ফের ফিরে যাচ্ছেন তারা। তাদের জমানো টাকা ফেরত পাবে কিনা তাও জানেনা গ্রাহকেরা। বর্তমানে আমানতকারীরা তাদের টাকা ফেরত পাওয়া নিয়ে পড়েছেন চরম অনিশ্চয়তায়।
ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করে বলেন, সমবায় থেকে নিবন্ধন নিয়ে সংস্থার প্রধান আবদুর রব কার্যত ব্যাংকিং কার্যক্রম শুরু করেন। গ্রাহকদের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার জন্য এক লাখ টাকার বিপরীতে প্রতি মাসে ১৫ হাজার টাকার উচ্চ মুনাফা ও বিভিন্ন মেয়াদী আমানত দ্বিগুণ দেওয়ার মতো আকর্ষণীয় অফার ছিল। সংস্থার এসব লোভনীয় অফার নিয়ে মাঠকর্মীরা সাধারণ মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে সংস্থায় টাকা জমা রাখার জন্য উৎসাহিত করতেন। আর এভাবেই নুর মিয়ারহাট এলাকায় প্রায় পাঁচ শতাধিক ও উপজেলা সদরে প্রায় চার হাজার গ্রাহকের কাছ থেকে অত্যন্ত ১০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় সংস্থাটি।
দৌলতখানে সৈয়দপুর ইউনিয়নের ছোটধলী গ্রামের কৃষক আবুল কালাম বলেন, আমি একজন কৃষক। কৃষিকাজের পাশাপাশি গরু-ছাগল পালন করতাম। অসুস্থতার কারণে গরু-ছাগল বিক্রি করে ৫ লাখ টাকা পাই। এই টাকা ঘরেই ছিল।
পরে আইডিয়াল মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটির মাঠকর্মী রাসেলসহ কয়েকজন আমার বাড়িতে গিয়ে আমাকে ডাবল মুনাফার লোভ দেখায়। বলেছে ৫ বছর পর ৫ লাখে আরও ৫ লাখ সহ মোট ১০ লাখ টাকা দেবে।
পরে আমার টাকা এ ব্যাংকে (নিউ আইডিয়াল মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি) জমা রাখি। মাসে মাসে কিছু টাকা লাভ দিত। কিন্তু গত কয়েকমাস লাভ দেওয়া বন্ধ করে দেয়। নভেম্বর মাস থেকে অফিস তালা মারা দেখতেছি। ব্যাংকের কাউকে খুঁজে পাচ্ছি না। প্রতিদিন আসি খোঁজ নিতে, আজও এসেছি। কাউকে পাচ্ছি না। আমার টাকার কী হবে?
সুরমা বেগম বলেন, আমার স্বামী দিনমজুর। অনেক কষ্ট করে ৩০ হাজার টাকা জমা রাখছি। ২ বছর পর ৩০ হাজার টাকাসহ মোট ৪২ হাজার টাকা দেবে। গত কয়েকদিন ধরে অফিসে আসতেছি। এসে দেখি অফিস তালা মারা।
নিউ আইডিয়াল মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটির নুর মিয়ারহাট তালাবদ্ধ কার্যালয়ের সামনে বসে আছেন বিধবা মাজেদা বেগমসহ নিম্নবিত্ত কয়েকজন নারী। মাজেদা বলেন, আমার স্বামী মৃত্যুর আগে আমার জন্য রেখে যান ৩ লাখ টাকা।
আমার বেঁচে থাকার শেষ সম্বল ৩ লাখ টাকা এখানে জমা রেখেছিলাম। প্রতিমাসে লাভের টাকায় চলতো চিকিৎসার খরচ চলত। কিন্তু গত ১ মাস ধরে রোজ সংস্থার অফিসে এসেও কাউকে না পেয়ে কান্নাকাটি করে ফিরে যাচ্ছি।
সমবায় সমিতি দুটির সভাপতি আব্দুর রবের মোবাইল ফোনে কল দিয়ে বন্ধ পাওয়ায় তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে তার ব্যবহৃত ফেসবুক আইডিতে তিনি লিখেছেন, তার বাড়িঘর বিক্রি করে হলেও গ্রাহকদের আমানত ফিরিয়ে দেবেন।
ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে দৌলতখান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. জিল্লুর রহমান বলেন, নিউ আইডিয়াল মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি নামের সমিতি গ্রাহকদের সঙ্গে তাদের ঝামেলা চলছে, আমি শুনেছি। তবে কোনো গ্রাহক থানায় এসে লিখিত অভিযোগ দেননি। অভিযোগ পেলে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
জেলা সমবায় কার্যালয়ের উপ সহকারী কর্মকর্তা আব্দুল মতিন বলেন, সমবায় আইন অনুযায়ী প্রতিবছর সমবায় সমিতি নিরীক্ষা করা হয়। দৌলতখানের আইডিয়াল মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড ও নিউ আইডিয়াল মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি সমবায় সমিতির নিবন্ধন নিয়ে ব্যাংকিং কার্যক্রমের বিষয়টি জানা নেই।
এছাড়া আমাদের কাছে কোনো অভিযোগ নেই। কোনো গ্রাহক অভিযোগ দিলে আইন অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সমবায় আইন অনুযায়ী গ্রাহকদের টাকা আদায়েরও ব্যবস্থা আছে।